চলুন, আজ এক অসাধারণ মানুষ আর একটা নোংরা সমাজ নিয়ে কিছু কথা বলি—
ছবিতে সম্পর্কে উনি আমার জ্যাঠা হবেন। নাম, মাওলানা শামসুল হক। উনি ছিলেন আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়ে হাজার মানুষ জীবন শুরু করল। খুবই নম্র, ভদ্র, একেবারে স্বল্পভাষী এক মানুষ ছিলেন। তাঁর চোখেমুখে ছিল এক ধরনের শান্ত আলোকচ্ছটা, যা মানুষের মন ছুঁয়ে যেত সহজেই। দেখা হলে একবার ভালোর কথা জিজ্ঞেস করতেনই। তাঁর জীবন কেবল শিক্ষকতা আর অধ্যবসায় নয়, বরং শ্রেণিসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে, তিনি ছিলেন এক মানবতার ফেরিওয়ালা।উনি এলাকার অন্যতম ধনী ছিলেন। টাকা, পয়সা, ধন-দৌলত, ওনাদের কোনো কালেই কমতি ছিল না। সমাজের গভীরে প্রোথিত শ্রেণিবৈষম্যের যে এক বিষাক্ত শেকড় চলতে থাকে, সেটা তাঁর মধ্যে কিঞ্চিৎও ছিল না। বরং মানুষের সঙ্গে এমন দারুণভাবে কথা বলতেন যে, কখনো বুঝতেই দিতেন না যে, এই লোক সমাজের নিম্ন-শ্রেণীর, ওই লোক সমাজের উচ্চ-শ্রেণীর। তাঁর মধ্যে দেখা যায় মার্ক্সীয় এক মানবিকতা, যেখানে শ্রেণি নয়, মানুষই মুখ্য।ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দাসপ্রথা বা জমিদার প্রথার মৃত্যু সেই অনেক আগে হলেও, আমাদের গ্রামে এর প্রভাব ছিল রীতিমতো ভয়ানক। কিছুটা হলেও আমার নিজ চোখে সেই ভয়ানক সময়ের কিছু দৃশ্য দেখা হয়েছিল। তখনকার সময়ে আমাদের গ্রাম ছিল কৃষিনির্ভর। এখনকার মতো এতটা সমৃদ্ধ ছিল না। পড়াশোনা ছিল সীমিত, অবশ্য এখনও সীমিত। দারিদ্র্যের আঁধার ছিল গভীর। এই বাস্তবতায় গড়ে উঠেছিল এক প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যারা একসময় জোর-জুলুম করে, মানুষের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল; দাঁড়িয়ে গিয়েছিল স্বঘোষিত বুর্জোয়া কাঠামোয়। কৃষিনির্ভর হওয়ায় এখানের বিশাল একটা অংশ ছিলেন চাষি আর জেলে। এই প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মানুষগুলো ওই গোষ্ঠীর কাজকর্ম শুরু করে। কেউ তাদের জমি বর্গা নেয়, কেউ বদলা দেয়। এভাবে সুবিস্তৃত হতে থাকে তাদের প্রভাব। তারা ছিল খুবই বিচক্ষণ। কিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়ে পুকুর খনন করে। আর সেই পুকুরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক ভিন্ন জগতের আয়োজন। হৈচৈ আর নানা রঙের শ্লোক, গিদ গেয়ে জেলেরা মাছ ধরে। ধীরে ধীরে এখানে জন্ম নেয় এক প্রকার দাসপ্রথা; নেমে আসে সামাজিক নিপীড়ন ও অবিচারের নতুন রূপ।ঐ প্রলেতারিয়েত শ্রেণির চাষাভুষারা সেই শোষকশ্রেণীর তাবেদারি শুরু করে। ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে একটু ভালোভাবে চললে, কথায় তাল দিলে চললে, বিনিময়ে তারা ধান চাষের জন্য জমি পাচ্ছে, বদলা দেওয়ার কাজ পাচ্ছে, মাছ ধরার পুকুর পাচ্ছে। তোষামোদে তাদের অন্য যোগাড়ও হচ্ছিল। এভাবে জমজমাট হয়ে উঠেছিল এক ভয়ানক চেতনা। ঐ গোষ্ঠীরা মধ্যবিত্ত বা লাঠিয়াল শক্তির দিক দিয়ে যারা দুর্বল, তাদের নানাভাবে টর্চার ও হেনস্তা শুরু করে। গ্রামে বিচারের নামে ছিল প্রহসন । গ্রামের একাংশ হয়ে উঠেছিল শোষক আর দাসের অবাধ চলাচলের জায়গা। তারা মিলেমিশে মানুষের নামে নানা কুকীর্তি আর বাজে মন্তব্য ছড়িয়ে দিত, আবার যাকে-তাকে ইচ্ছেমতো হুমকি, গালাগাল করত বিনা কারণে। কিন্তু এখানে একটা আয়রনি ঘটে, যে জেলে, চাষিরা ছিল ”আদারস পিপল, মার্জিনালাইজড পিপল" একটা সময় সেই শোষকের দাসত্ব করেই এরাও হয়ে ওঠে সেন্ট্রাল পিপল। মাক্সের ভাষায় যেটাকে বলে False consciousness, যেখানে শোষিত শ্রেণিই শাসকের হাতিয়ার হয়ে যায়।এই দমবন্ধ পরিস্থিতির মাঝেও শিক্ষক শামসুল হক ছিলেন এক আলাদা সত্তা। তাঁর আর্থিক স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও তিনি কখনো ক্ষমতার আশ্রয় নেননি। বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে, এই কথিত বুর্জোয়া শোষকদের বিরুদ্ধে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু একা মানুষ, বিশাল এই গোষ্ঠীর সামনে টিকে থাকা সহজ ছিল না। উনি নিজেও সেই গোষ্ঠীর শিকার হয়েছিলেন। আমার বাবা প্রায়ই বলতেন, “তোমার এই জেঠার সাথে কখনো বেয়াদবি করো না। উনি ভীষণ ভালো মানুষ। তোমার ভাইয়ের জানাজা দিয়েছেন।” সে আরেক গল্প। আমার বড় ভাই, খুব ছোট বেলায় পানিতে পড়ে মারা যান। কিন্তু আমার ভাইকে জানাজা দিতে দেবে না ঐ গোষ্ঠী। কারণ? আমার মা তখন গ্রামের ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, পাশাপাশি আইএতে পড়তেন। মা’র শিক্ষকতায় নাকি সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, গ্রামের মেয়েরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! তাই, আমার মা’র শাস্তি না হয়ে, মাটি দিতে দেবে না। অথচ, ঐ গোষ্ঠীর মেয়েরা ৬/৭ শ্রেণি অবধিও পড়াশোনা করেন নাই বোধহয়। আর সে সময়ে আমার মা ময়ুরা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেছিলেন, আবার শিক্ষকতাও করতেন। বোধহয় তারা সেটা ভালোভাবে নিতে পারেনি।যাহোক, অবশেষে রাত হল। শিক্ষক শামসুল হক হুজুর, আমার ভাইয়ের জানাজা দেন। আর ঐ গোষ্ঠী আমার মাকে পড়াশোনা ও ব্র্যাক স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য করেন। এমনকি আমার বড় মামাকেও কানে ধরায়। অবশ্য সেদিন এখন ভুলে গেছে। এখন আর সে সাহসের ছোঁয়াও নেই। কিন্তু আমার ভাইয়ের জানাজা যিনি দিয়েছিলেন, সেই উপকারটা আমার মা-বাবা কখনো না ভোলার জন্য বলেছেন।সেদিন সে গল্প শোনার পর, তাঁর প্রতি আমার ভীষণ শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। একবার আমার মনে আছে, আমি তখন বরিশালে পড়াশোনা করতাম। বাড়িতে ফিরলে ওনার সঙ্গে দেখা হলে, উনি বললেন, “একটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো, তোর মা অনেক কষ্ট করে টিকে আছেন।”এছাড়া এখানে-সেখানে দেখা হলে আমাকে ভালোর কথা জিজ্ঞেস করতেন, পড়াশোনার খবর নিতেন। সত্যি বলতে, আমার এতটুকু জীবনে শিক্ষক শামসুল হককে a silent dissenter হিসেবেই চিনি। যাকে কখনো কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখি নাই, গলার স্বর উঁচু করে কথা বলতে দেখি নাই। এমন এক নীরব মানুষ ছিলেন, এতটাই শান্ত! এক অত্যাচারী, শোষক গোষ্ঠীর দাস ও চাটুকারদের মাঝে তিনি ছিলেন এক স্বতন্ত্র মানুষ, যার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধের সংজ্ঞা পাওয়া যায়।এখন সে গ্রামের মানুষের বেশ সৌভাগ্য যে, ঐ দাসপ্রথা আর শোষক গোষ্ঠীর সেই দৌরাত্ম্য নেই। ওরা হয়তো ভুলে গেছিল যে, এই পৃথিবীতে কেউই বাঁচার জন্য আসে না।কিন্তু শেষ পরিণতিটা এমন হবে, কখনো ভাবিনি। নিয়তির চিত্র সময়ের পরিবর্তনে উল্টে যায়। যেখানে একসময়কার শোষক গোষ্ঠী ছিলেন , এখন তারা, শিক্ষক শামসুল হকের ছেলেদের তোষামোদ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যারা আগে শোষক ছিল, যাদের ছিল অনেক গ্যাং,দাস, নিয়তির প্রভাবে আজ তারা বাপ-দাদাদের শোষণের কথা ভুলে গিয়ে নিজেরাই চাটুকারিতা, তাবেদারি প্রথা চালু করতে চায়! যেখানে dialectical reversal ঘটে। অর্থাৎ ইতিহাসের দ্বন্দ্বময় উল্টোচক্র, যেখানে প্রমাণিত হয় সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্র কখনো স্থির থাকে না; তা ঘুরে ফিরে শোষিতদের হাতেই শক্তি ফিরিয়ে দেয়। এখানে অবশ্য স্পিভাকের Subaltern ধারণা খুব শক্তিশালীভাবে ফুটে উঠেছে । যেই সমাজ একসময় নীরব ছিল, এখন সেই সমাজ নিজস্ব কণ্ঠে কথা বলছে। ভালোই লাগে। সমাজে এখন কেউ জোর খাটাতে পারে না। তাদের বাপ-দাদাদের যে গ্যাং ছিল, গোষ্ঠী ছিল, সেটা এখন বিলুপ্ত। এখন আমার গ্রামে লিইড দেয় শিক্ষক শামসুল হক মৌলবির ছেলেরা। কিন্তু তারা কোনোভাবেই চাটুকারিতা এসবের স্থান দেন না, আশাবাদী দেবেনও না।এই সমাজটা গ্যাং আর শোষক, গোষ্ঠীমুক্ত হোক— এটাই চাই। এখানে কোনো শ্রেণি সংগ্রামের বৈষম্য না থাকুক। এখানে স্বাধীনতা থাকুক।যাহোক, পরিশেষে আমি বারবার স্মরণ করছি; an ethical rebel ম্যান, শিক্ষক শামসুল হককে, যিনি সেই মুক্তির স্বপ্নের ধারক, যিনি সমাজে ন্যায়বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন, শোষণের বিরুদ্ধে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যিনি ছিলেন a man of praxis।চিরকাল উনি আমার সমাজ-ইতিহাসের এক প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবেন। আজ উনাকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। কিছুদিন আগে উনি মহান রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সবাই ওনার জন্য দোয়া করবেন; মহান রাব্বুল আলামীন তাঁকে বেহেশত নসীব করুক।এবিএস নাদিম এর ফেইজবুক ওয়াল থেকে নেয়া.........................