#আবদুর রহমান#
সোমবার বেলা ১১টা। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক হয়ে বিজয়পুর রেলগেট এলাকায় যেতেই চোখে পড়ল কয়েক শ মানুষের জটলা। সেখানে কেউ ক্রেতা, কেউ বিক্রেতা। একটু কাছে যেতেই চোখে পড়ল ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর-কষাকষি চলছে। তবে সেখানে কোনো পণ্য নেই, এরপরও বেচাকেনা যেন জমজমাটভাবেই চলছে। কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, এখানে বিক্রি হয় মানুষের শ্রম।
সেখানে থাকা ব্যক্তিদের কারও হাতে কাঁধের ভার, আবার কারও হাতে কাস্তে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ‘শ্রম বিক্রি’ করতে এসেছেন তাঁরা। বর্তমানে বোরো ধান কাটার মৌসুম চলছে। এই সময়ে ‘শ্রম বিক্রির হাট’ জমজমাট হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর বাজার লাগোয়া রেলগেট এলাকার এই শ্রম বিক্রির হাট অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। বোরো ধান রোপণ ও কাটার সময় শ্রমিকদের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ফলে বোরো মৌসুমসহ বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষিশ্রমিকেরা আসেন। হাটে কুমিল্লা ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে গৃহস্থরা আসেন কৃষিশ্রমিক নেওয়ার জন্য।
হাটে আসা বিজয়পুর এলাকার গৃহস্থ আবদুল খালেক বলেন, ‘আমার বাড়ি পাশের এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই এখানে মানুষের হাট দেখে আসছি। এই হাটে সারা বছরই লোক বিক্রি হয়। তবে বর্তমানে ধান কাটার সময়ে লোকের দাম বেশি। যেমন আজকে লোক নিলাম ৯০০ টাকা দিয়ে। তাঁর থাকার ব্যবস্থার পাশাপাশি তিন বেলা খাবার দিতে হবে। সেই হিসাবে একজন শ্রমিকের পেছনে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা খরচ পড়বে, যা অনেক বেশি।’
বোরো ধান কাটার সময়ে চাহিদা বেশি থাকায় মজুরি বেশি হয়। এতে খুশি শ্রমিকেরা। অন্যদিকে গৃহস্থরা বলছেন, কৃষিশ্রমিকদের এক দিনের খরচ প্রায় দেড় মণ ধানের দামের সমান।
রংপুরের পীরগঞ্জের সায়োদি গ্রাম থেকে বিজয়পুরের এই হাটে এসেছেন মনোয়ার হোসেন। তাঁর সঙ্গে বিজয়পুর এলাকার গৃহস্থ আবদুল খালেকের দর-কষাকষি হয়। খাওয়া ও থাকা বাদে প্রতিদিন মজুরি হিসেবে এক হাজার টাকা দাবি করেন চল্লিশোর্ধ্ব মনোয়ার। আবদুল খালেক ৭০০ টাকা থেকে দর-কষাকষি শুরু করে সর্বশেষ ৯০০ টাকায় তাঁকে চূড়ান্ত করেন।
মনোয়ার হোসেন বলেন, ২০ বছর ধরে তিনি এখানে আসেন। এখন দাম ভালো পাচ্ছেন। কদিন পর দাম কমে যাবে। ২০ থেকে ২৫ দিন কাজ করে তিনি বাড়ি যাবেন। ভালো কাজ পারলে হয়তো আরও কিছুদিন থাকবেন।
লাকসাম উপজেলার উত্তরদা ইউনিয়নের মামীশ্বর এলাকা থেকে কৃষিশ্রমিকের জন্য এসেছেন আবুল হাসেম। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৬৩ বছর। ১০ বছর বয়সে এই হাটে বাবার সঙ্গে এসেছি শ্রমিক নেওয়ার জন্য। তাহলে চিন্তা করেন কত বছরের পুরোনো হবে এই হাট!’
কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিজয়পুর রেলগেট ছাড়াও কুমিল্লার আরও বেশ কিছু স্থানে এভাবে শ্রম বিক্রির হাট বসে। তবে বিজয়পুর হাট সবচেয়ে বড়। কুমিল্লা নগরে কান্দিরপাড়, শাসনগাছা, চৌয়ারা, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার, সুয়াগাজী বাজার, বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার, লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজার, লাকসামের বিজরা বাজারসহ জেলার অন্তত ২০টি স্থানে এভাবে শ্রম বিক্রির জন্য শ্রমিকেরা জড়ো হন। এসব হাট থেকে শ্রমিকদের চুক্তিতে কৃষি, রাজমিস্ত্রি, গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজের জন্য নেওয়া হয়। রংপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শ্রমিকেরা ভিড় করেন এসব শ্রম বিক্রির হাটে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক আইয়ুব মাহমুদ বলেন, এ বছর কুমিল্লায় বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৯০ হেক্টর। এর মধ্যে ধারণার চেয়ে বেশি ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৭১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে প্রতিটি উপজেলায় খবর নিয়ে জানতে পেরেছেন। এরই মধ্যে জেলার প্রায় ১২ শতাংশ জমিতে ধান কাটা হয়েছে। শ্রমিকেরা চাহিদা তাই এখন বেশি।