মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন
কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার ইসলামপুর উচ্চবিদ্যালয়ে নড়বড়ে টিনশেডের কয়টি কক্ষেই চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম।এমন পরিবেশে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে কষ্টের যেন সীমা নেই । গ্রীষ্মকালের উত্তপ্ত খরতাপে শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে হয় শিক্ষকরা।প্রতিবছরই উত্তপ্ত গরমে অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শীতকালে হাড়কাঁপা শীতে হুবু যুবু অবস্থা আর বর্ষাকালেতো কষ্টের সীমাই নেই। একটু বৃষ্টি হলেই শ্রেণিকক্ষে ডুকে পড়ে পানি। প্রায় শিক্ষার্থীরই বই খাতা ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। ২০২৪ সালের আকস্মিক বন্যায় বিদ্যালয় এর শ্রেণিকক্ষে ও মাঠে বুক সমান পানি ওঠে। এমন দুরবস্থায় ফলে শিক্ষার্থীরা অত্র বিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে পেলেছে। অথচ শিক্ষা দীক্ষা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে রয়েছে।জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিক থেকে প্রতিবছর প্রায় শতভাগ পাশসহ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। অত্র বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা আজ বিসিএস শিক্ষা, বিসিএস স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োজিত রয়েছে, এছাড়াও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থায় উচ্চপদস্থ পদে চাকুরী করছেন।দেশ-বিদেশে অনেক শিক্ষার্থী আজ প্রতিষ্ঠিত। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পৌরসভার অদূরে নাঙ্গলকোট বাঙ্গড্ডা পাকা সড়কের পাশেই অত্যন্ত একটি চমৎকার জায়গায় বিদ্যালয়টি অবস্থিত। বিদ্যালয় পাশেই রয়েছে সাবিত্রা বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সামনে রয়েছে বিশাল একটি খেলার মাঠ, মাঠের দক্ষিণে ডাকাতিয়া নদীতে বয়ে যাওয়া গাগৈর খাল পশ্চিমে রয়েছে ঈদগাহ ও সুন্দর একটি মসজিদ। বিদ্যালয়টিতে দক্ষিণ মুখী তিন কক্ষ বিশিষ্ট একতলা একটি পাকা ভবন আর পূর্বপাশে পশ্চিম মুখী দুইটি ভগ্ন দশা টিনশেড রয়েছে। টিনশেডগুলোর ভিতরের অবস্থা খুবই নাজুক। আসবাবপত্র অপ্রতুল।টিনশেড গুলোতে চারটি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। যেগুলোতে শিক্ষা প্রদানের জন্য মোটেও উপযুক্তপরিবেশ নাই।আর পাকা ভবনটিতে তিন কক্ষের মাঝে একটিতে অফিস কক্ষ একটিতে সাইন্স ল্যাব পাঠাগার আর অন্যটিতে একটি মাত্র শ্রেণীকক্ষ। এলাকাবাসী থেকে জানা যায়, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া অত্র উপজেলার মক্রবপুর ইউনিয়নের ভূলুয়াপাড়া,কনকৈইজ, এলোনিয়া, সাহেদাপুর,মাইরাগাঁও মক্রবপুর; পেরিয়া ইউনিয়নের জোড়পুকুরিয়া ও পৌরসভার নাঙ্গলকোট, মান্দ্রা, অশ্বদিয়া, জোড়পুকুরিয়া গ্রামগুলো।অত্র এলাকার গ্রামগুলোর শিক্ষার দুরঅবস্থার কথা বিবেচনা করে ১৯৯৫ সালে অত্র এলাকার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি আলহাজ্ব সাদেক হোসেন চেয়ারম্যান,দানবীর ও শিক্ষানুরোগী আলহাজ্ব মুন্সী ফজলে আলী, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক আলহাজ্ব যৌবন আলী মেম্বার, আলহাজ্ব মাস্টার আব্দুর রাজ্জাক,আব্দুল কাইয়ুম কমিশণার, মাস্টার ইয়ার আহম্মদ, মাস্টার আমিনুল্লাহ, কাজী আব্দুল হক, কাজী মোজাম্মেল হক, মাস্টার আব্দুর রশিদ, আব্দুল কাদের মুহুরী,আব্দুল মান্নান, আব্দুর রব আলী আকবরসহ এলাকার শিক্ষা সচেতন সকল শ্রেণির মানুষগুলো শিক্ষার উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে পৌরসভা, মক্রবপুর ইউনিয়ন ও রায়কোটি ইউনিয়নের মোহনায় ভূলুয়াপাড়া গ্রামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।প্রথমত এলাকাবাসীর দান অনুদানে টিনশেডের কয়েকটি কক্ষ তৈরি করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। পরে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য আলহাজ্জ জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়ায় তিন কক্ষের একটি ভবন বরাদ্দ করেন। সেই ভবন আর ভাঙ্গা টিনের ঘরেই একমাত্র ভরসা। সেই থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত অত্র বিদ্যালয়ে আর কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বিগত সরকারগুলোর বিভিন্ন প্রতিনিধি ও কর্তা ব্যক্তিরা আশার বাণী শোনালেও বাস্তবে কোন উন্নয়ন করনি। এলাকার অভিভাবক ফরিদ উল্লাহ জানায়, অত্র এলাকার মুরুব্বীরা শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বিদ্যালয়টিতে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও আসবাব পত্রের অভাবে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আমরাও আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে অত্র বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে মানসিক অশান্তিতে আছি। আসবাবপত্র ও শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যেতে চায় না। তাই সরকারকে এখানে নতুন ভবন নির্মাণ ও আসবাবপত্রসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দশম শ্রেণীর ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস রোমান জানান, আমরা পার্শ্ববর্তী সাবিত্রা বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাশ করার পরে অত্র বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কিন্তু আমাদের সহপাঠীরা এই বিদ্যালয়ের অব কাঠামোগত দুরবস্থা দেখে এখানে ভর্তি হয়নি। তারা প্রায় পাঁচ মাইল দূরের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এই ভগ্ন দশা শ্রেণিকক্ষ গুলোতেই অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও পড়ে আসছি । এ আই এর যুগে এই বিদ্যালয়টিতে একটি কম্পিউটার ল্যাব , বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো মানের একটি ভালো বিজ্ঞানাগার নাই। এই দুরবস্থার উন্নয়ন না হলে অদূর ভবিষ্যতে কোন শিক্ষার্থীই এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে না। এসএসসি পরীক্ষার্থী মহিবুল্লাহ মোহন বলেন, গরমের দিনে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলোতে অসহনীয় গরম, শীতকালে টিনশেডের শ্রেণিকক্ষগুলোতে দরজা-জানলা না থাকায় ঠান্ডায় শরীর হিম হয়ে যায় আর বর্ষাকালে ছাত্র-ছাত্রীদের বই খাতা ভিজে যায়। ভাঙ্গাচুরা বেঞ্চে ও ভেড়ার ভাঙ্গা টিনের বিভিন্ন টুকরায় আমাদের জামা কাপড় লেগে ছিড়ে যায়। আমরা অনেক কষ্টে বিদ্যালয়গুলোতে এত বছর পার করেছি। এরকম কষ্ট করে আমার মনে হয় বাংলাদেশে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় না। তাই আপনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের মত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে জরুরী ভিত্তিতে নতুন ভবন নির্মাণসহ আসবাপত্রের সমস্যাগুলো দূর করবে। উক্ত বিষয়ে অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ শহিদুল্লাহ মজুমদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও দানবীর ব্যক্তিরা এলাকার শিক্ষা দীক্ষার উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে অত্র বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিদ্যালয়টিতে এক ঝাঁক তরুণ ও মেধাবী শিক্ষক রয়েছে। নানাহ অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় বিদ্যালয়টিতে শ্রেণিকক্ষ আসবাবপত্র ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে আমরা এলাকার মেধাবী শিক্ষার্থীগুলো পাচ্ছিনা। সচেতন কোন অভিভাবকেরা অত্র বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের দিতে চাচ্ছে না। এই এলাকার শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে অন্য বিদ্যালয় চলে যায়। আমরা কিছুই বলতে পারছি না। আমি অনেক চেষ্টা করেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখানে একটি ভবন আনতে পারিনি। বিগত সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আশ্বাস দিয়েও অন্তত একটি ভবন বরাদ্দ দেয়নি।তাই এই অবস্থায় চলতে থাকলে আগামী বছরগুলোতে আমরা কোন শিক্ষার্থী পাবো না।শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি ও উন্নয়নে জরুরী ভিত্তিতে এ বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণসহ আসবাবপত্রের সমস্যা দূর করতে হবে। উপজেলা শিক্ষক অফিসার মোহাম্মদ ইউনুছ এর কাছে অত্র বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও আসবাবপত্রের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বিদ্যালয়টি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি এবং শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে অবগত হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে একটি নতুন ভবনের জন্য উপজেলা কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।আশা করি এসব সমস্যার সমাধান অচিরেই হয়ে যাবে।