বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি টাকার ওপরে সরকারি বরাদ্দ এনে চারতলা আলিশান বাড়ি তৈরি করার অভিযোগ উঠেছে হুমায়ুন কবির মজুমদার নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। তিনি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা পেরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে ছিলেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় মামলায় গত মাসে ডিবি পুলিশ তাকে কুমিল্লার বাসা থেকে আটক করে। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি নামে-বেনামে বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে জেলা পরিষদের ১ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং কাকৈরতলা উচ্চবিদ্যালয়ে ভুয়া পরিচালনা কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিয়োগ-বাণিজ্য করে প্রায় ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে গত ১৬ বছরে প্রায় শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার নানা অনিয়মের বিষয়ে উপজেলার পেড়িয়া ইউপির কাকৈরতলা গ্রামের কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হুমায়ুন কবির তার নিজ বাড়িতে চার তলাবিশিষ্ট একটি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করছেন, যা বর্তমানে অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ আওয়ামী লীগ নেতা তার মা আংকুরের নেছা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, আংকুরের নেছা মসজিদসহ নামে-বেনামে কুমিল্লা জেলা পরিষদ থেকে এসব বরাদ্দ আনেন। অথচ বড়স্বাঙ্গিশ্বর গ্রামের আংকুরের নেছা নামে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নেই বলে দাবি করছেন এলাকাবাসী।
দুদকে দেওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, হুমায়ুন কবির কুমিল্লা জেলা পরিষদ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে উপজেলার পেড়িয়া ইউপির কাকৈরতলা পীর কাজির উদ্দিন মাজার সংস্কারে ৩ লাখ টাকা, বড়স্বাঙ্গিশ্বর পীর কাজির উদ্দিন মাজার সংস্কারে ২ লাখ টাকা, বড়স্বাঙ্গিশ্বর চেয়ারম্যান বাড়ি সংলগ্ন কবরস্থান উন্নয়নে ৩ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে কাকৈরতলা মাজার উন্নয়নে ৩ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাকৈরতলা গোলাবাড়ি হাজী ছিদ্দিকুর রহমানের বাড়ির পার্শ্বে কবরস্থান উন্নয়নে ২ লাখ টাকা, বড়স্বাঙ্গিশ্বর উচ্চবিদ্যালয় উন্নয়নে ২ লাখ টাকা, কাকৈরতলা উচ্চবিদ্যালয় উন্নয়নে ২ লাখ টাকা, বড়স্বাঙ্গিশ্বর উত্তর পাড়া জামে মসজিদ উন্নয়নে ২ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বড়স্বাঙ্গিশ্বর উচ্চবিদ্যালয় উন্নয়নে ২ লাখ টাকা, কাকৈরতলা উচ্চবিদ্যালয় উন্নয়নে ২ লাখ টাকা, বড়স্বাঙ্গিশ্বর পীর কাজিম উদ্দিন জামে মসজিদ উন্নয়নে ৩ লাখ টাকা এবং বড়স্বাঙ্গিশ্বর গ্রামে বেগম আংকুরের নেছা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও পরে মহিলা মাদ্রাসার নামে একাধিক সময়ে ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়ে নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন। এ ছাড়া জেলা পরিষদ থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা আত্মসাতের লিখিত অভিযোগ রয়েছে।
এতেও ক্ষান্ত হয়নি এই আওয়ামী লীগ নেতা। ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় হতদরিদ্রদের ভিজিএফের চাল আত্মসাৎ এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে হতদরিদ্রদের সরকারিভাবে ঘর দেওয়ার কথা বলে প্রতি পরিবার থেকে ১০ হাজার টাকা করে প্রায় ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। পরে এ নিয়ে তার নিজ গ্রাম বড়স্বাঙ্গিশ্বরের যুবকরা ফেসবুকে লেখালেখি করলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজে এবং তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুবকদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা করে চারজনকে গুরুতর জখম করেন। পরে এ নিয়ে থানায় মামলা হয়, যা চলমান।
২০২২ সালের ১ এপ্রিল উপজেলার কাকৈরতলা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের কোনো ধরনের তফসিল ঘোষণা না করে হুমায়ুন কবির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমানকে নিয়ে ভুয়া কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির দুই অভিভাবক সদস্য দুলাল হোসেন ও মিজানুর রহমান তাকে অনিয়মে সহযোগিতা করেন। সাতজন কর্মচারী নিয়োগে প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে।
নাম না প্রকাশ করা শর্তে বড়স্বাঙ্গিশ্বর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, হুমায়ুন চেয়ারম্যান নামে বেনামে অনেক সরকারি বরাদ্দ এনে তার মায়ের নামে মসজিদ মাদ্রাসা দেখিয়ে চারতলা বাড়ি করছেন। এসব কাজের তদারকি দায়িত্বে ছিলেন কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রকৌশলী শরীফ।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা দুদক উপপরিচালক মো. ইসমাঈল হোসেন বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ এলে তা আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়ে দিই। তারা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা পরিষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম দেশ বলেন, ‘আমি এখানে আসছি মাস খানেক হয়। তবে আগে কী হয়েছে আমার জানা নেই। এখন থেকে এ অফিসে একটি টাকাও দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। আর এ চেয়ারম্যানের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।’