এ জেড ভূঁইয়া আনাস
১৭ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) শীর্ষ পদ দখলে রেখেছিলেন নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার। ব্যাংক মালিকদের শীর্ষ পদ দখলে রেখেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রভাব খাটিয়ে বের করে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ ব্যাংক মালিকদের নেতা হিসেবে এসব অনিয়ম ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল তার।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের এক শাখা থেকেই ২ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে মজুমদারের নাসা গ্রুপ। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এত টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই এক শাখা থেকে। এজন্য প্রভাব খাটিয়ে বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এসব ঋণের প্রায় অর্ধেক। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের সাবেক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপককে দায়ী করছেন ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকেই ২ হাজার ১০২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে। আর বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছে আরও ৯৯৮ কোটি টাকা। এসব ঋণের বেশিরভাগই দিয়েছেন লোকাল অফিসের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিসে বিএবির সদ্য সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা তাইপেই ডেনিমসের ঋণের পরিমাণ ২৮৮ কোটি টাকা। এই ঋণের ১৪৪ কোটি টাকাই নেওয়া হয়েছে বিশেষ বিবেচনায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ১৪৪ কোটি টাকার ঋণ নিতে পারত। কিন্তু বিদায়ী সরকারের প্রভাব খাটিয়ে নজরুল ইসলাম বিশেষ বিবেচনায় আরও ১৪৪ কোটি টাকা ঋণ নেন। বর্তমানে এসব ঋণের ৫১ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা নাসা স্প্যানিং লিমিটেডের ১৬৩ কোটি টাকার ঋণে। প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকা। বর্তমানে ওই ঋণের ২৩ কোটি টাকাই মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া নাসা স্পেনার্স লিমিডেটের ঋণের পরিমাণ ৬০ কোটি টাকা। এই প্রতিষ্ঠানকেও ৭ কোটি টাকার বিশেষ বিবেচনার ঋণ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ১৮ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা সুপার গার্মেন্টসের বর্তমান ঋণের পরিমাণ ২৩৪ কোটি টাকা। এসব ঋণের সাড়ে ৯ কোটি টাকা বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকার ঋণ। আর নাসা সুপার ওয়াশ লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ ২০৯ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ১৩ কোটি টাকা।
নাসা অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ আরও ১২ প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ৬৬৮ কোটি টাকাই নেওয়া হয়েছে বিশেষ বিবেচনায়। বর্তমানে এসব ঋণের প্রায় শতকোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, নজরুল ইসলাম মঞ্জুমদারের নাসা গ্রুপ বিশেষ বিবেচনায় অতিরিক্ত ঋণ পেতে বেশিরভাগ সময় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিলসহ কয়েকটি অজুহাত দেখিয়েছেন। রপ্তানিমুখী শিল্প হওয়ায় ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণ বিতরণের কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করেনি।
তথ্য বলছে, ইসলামী ব্যাংকের ঋণগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ায় নাসা গ্রুপের পক্ষ থেকে চলতি বছরের মার্চ মাসে ঋণের কিছু অংশ পরিশোধ করে তা নিয়মিত রাখা হয়। কথা ছিল গত জুন ও সেপ্টেম্বরে আরও কিছু অর্থ পরিশোধ করা হবে; কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেসব ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়ে পড়ার শঙ্কাও রয়েছে।
সার্বিক বিষয় জানতে ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মুনিরুল মওলাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। আর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া নজরুল ইসলাম মজুমদার কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত অর্থসংগ্রহকারী ব্যাংকিং খাতের চাঁদা সংগ্রাহক হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম মজুমদার ইসলামী ব্যাংকে ২০১৭ সালের পর থেকে ঋণের ঘোড়া ছুটিয়েছেন। এর আগে গ্রাহক থাকলেও ঋণের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। এস আলম গ্রুপ কর্তৃক দখল নেওয়ার পর থেকে মজুমদার প্রভাব খাটিয়ে নিজেও ঋণ নিতে শুরু করেন। তার ঋণ হাতিয়ে নেওয়ার কারিগর স্বয়ং ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। মজুমদারের ঋণ মূলত দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক শাখা থেকে। এ শাখা থেকে ঋণ বৃদ্ধির বেশিরভাগ সময় দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ইভিপি মো. ওমর ফারুক খান। মজুমদারের নাসা গ্রুপকে অকৃপণভাবে ঋণ দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে তিনি মাত্র ছয় বছরের মধ্যে তিনটি প্রমোশন বাগিয়ে নিয়ে এএমডি হিসেবে ব্যাংক ছাড়েন ২০২৩ সালের ২৮ মার্চ। এই কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আবার ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেছেন।
নজরুল ইসলামের আরেক সহযোগী সাবেক এমডি ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়া মাহবুবুল আলম। অনৈতিকভাবে ব্যাংকের ঋণ পেতে তিনিও নজরুল ইসলামকে সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ইভিপি শফিকুর রহমান, যিনি লোকাল অফিস শাখার ম্যানেজার ছিলেন, তিনিও মূলত কাজ করতেন নাসা গ্রুপের হয়ে। শফিকুর রহমানের এক ছেলে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি হন। পরে সেখান থেকে অবসরে গিয়ে বর্তমানে নাসা গ্রুপে চাকরি করছেন। ঋণ প্রদানে ব্যাপক হারে সহযোগিতা পুরস্কার হিসেবে তিনি নাসা গ্রুপে উচ্চ বেতনে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমানে ব্রাঞ্চ কন্ট্রোল ডিভিশনের ইভিপি আনিসুর রহমান ও ফরেন ট্রেড অপারেশন ডিভিশনের এসভিপি মো. শাহজাহান ঋণ সংক্রান্ত দায়িত্বশীল পদে থেকে নাসা গ্রুপকে ঋণ পেতে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ আছে। নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপের ম্যানেজার ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের দীর্ঘদিনের সাবেক এমডি হায়দার আলী মিয়া, যিনি বর্তমানে নাসা গ্রুপের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, বিগত সরকারের সময় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রভাবশালীরা ঋণ বাগিয়ে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করেছেন, যাদের এসব ঠেকানোর কথা তারাই। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেও না দেখার ভান করেছে। মূলত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই এসব ঘটনা ঘটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংক সংস্কারে কাজ চলছে। এখন কোন ব্যাংকে কী ধরনের ঋণ অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। এরপর ঋণগুলো আদায়ে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
#সূত্র: দৈনিক কালবেলা