ড. শামসুজ্জামান মেহেদী
নিজের দেওয়া ২০২৪ সালে নির্বাচনী হলফনামার তথ্য ও ব্যাংকিং লেনদেনে ৭২ কোটি টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি ৮০ কোটি টাকা আয়ের তথ্য দিলেও এখন দুর্নীতি কমিশনের অনুসন্ধান টিমের তদন্তে এই হিসাব মিলাতে পারছেন না। কাগজপত্রে একটি খাতে ৮০ কোটি টাকা গচ্ছিত থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে আছে ৮ কোটি টাকা। তাহলে বাকি ৭২ কোটি টাকা গেলো কোথায়? এই টাকা কি বিদেশে পাচার হয়েছে? এ নিয়ে চলছে দুদকের অনুসন্ধান ও জল্পনা কল্পনা। সম্প্রতি নিজের মালিকাধীন দৈনিক পত্রিকায় এসম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিতের অপচেষ্টা চালিয়েছেন আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের কাছে স্যার খ্যাত সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। যাতে
বলা হয়, একটি “০” (শূন্য)র মূল্য যখন দাঁড়ায় ৭২ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা- ৯ আসন (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লার দাখিলকৃত হলফনামায় সরবরাহকৃত তথ্যের এক জায়গায় তার কাছে বিদ্যমান ৮ কোটি টাকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এনাকৃত বন্ড ঘোষণা করতে গিয়ে ভুলবশত টাইপিস্ট একটি শূন্য বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে ৮ কোটি টাকার স্থলে ৮০ কোটি টাকা হয়ে যায়। ফলে তার ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফ- নামায় দাখিলকৃত সম্পদের তুলনায় ২০২৪ সালের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়ে সাংবাদিকরা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দাখিলকৃত তথ্যগুলো পুনঃপর্যালোচনা করে দেখতে পান, ৮ কোটির সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল স্থলে একটি শূন্য বেশি হওয়ায়, ৮০ কোটি হয়ে গেছে। যার ফলে এই ক্ষেত্রে ৭২ কোটি টাকা বেশি হয়ে যায়। এই ৭২ কোটি টাকা তাহার মোট সম্পদ থেকে বাদ দিলে, ২০২৪ সালের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ কোটি ৬০ লাখ ৩০ হাজার ৮০০ টাকা। এটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলটি হিসেবে চালিয়ে দিতে গত মাসে তা সংশোধনের জন্য তিনি একটি নোটারি করে সংশোধিত হলফনামা নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অনেক দূর গড়িয়েছে। যা ধামাচাপা দেওয়াটা এখন কাষ্টসাধ্য ব্যাপার। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে এক লাফে কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে মোঃ তাজুল ইসলামের নাম ঘোষণা হয়। অনেকে ভেবেছিল ভুলে এটি হয়ছে। নামের আগে ক্যাপ্টেন শব্দ হবে, কারণ পূর্ণমন্ত্রীর সম্ভাব্য তালিকায় ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের নাম। তিনি ছিলেন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। প্রমোশন হয়ে পূর্ণমন্ত্রী হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না। ক্যাপ্টেন নয়, উনি কুমিল্লা-৯ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ তাজুল ইসলাম। প্রতিমন্ত্রী নন, এলজিআরডির পুর্নমন্ত্রী। তৃণমূলের রাজনীতিবিদ না হলেও ব্যবসায়িক কোটায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। তরতর করে উপরে উঠতে থাকেন। রাজনীতি ছত্রছায়ায় গড়ে তুলেছেন শিল্প কারখানা, ব্যাংক, বীমা সহ দেশ বিদেশে অঢেল সম্পদ। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনমলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা ভোট ও রাতের ভোটের কালচার চালু হলেও সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী এক্ষেত্রে আরো এক ধাপ এগিয়ে যান। নিজের নির্বাচনী এলাকা তিনি লাকসাম-মনোহরগঞ্জ থেকে এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রার্থীদের জয় লাভের কালচার দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেন। খুব অল্প সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার এই কালচার বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এত জনপ্রিয়-অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই মন্ত্রী লাকসাম মনোহরগঞ্জে এখন হাওয়া। আওয়ালমী লীগের নাম উচ্চারণ করার মত তার কোন কর্মী সমর্থক ও উজির, নাজির, খলিফা, সাধু-দরবেশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। ৫ আগস্ট শোকের মাসে নেতাকর্মীদেরকে সাগরে ভাসিয়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পর্দার অন্তরালে চলে যান সাবেক এই দাম্ভিক ও অহংকারী মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। বিক্ষুব্ধ বিএনপি জামাতের সমর্থক জনগণ অসাধারণ মানুষ সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের বাড়ি দুটিতে অগ্নিসংযোগ করে। স্যার ‘খ্যাত এই নেতার দায়িকতা ও অহংকারের উপযুক্ত জবাব দেয়।
উল্লেখ্য, সফল ব্যবসায়ী মোঃ তাজুল ইসলাম মন্ত্রী হয়েই সুদূরপ্রসারি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মিশন শুরু করেন। এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, ওয়াসা সহ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর পিডি ও প্রকৌশলীদের বদলীর ক্ষমতা নিজের হাতে আনেন। যার মাধ্যমে গত ৬ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বাণিজ্য হয়েছে। গিড়িদেরকে ৫০ লাখ ১ কোটি। প্রকৌশলীদের বদলি পোস্টিং এর জন্য ২০ থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত লেনদেন হতো বলে জানা যায়। মন্ত্রী তাজুল নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন। এসব তদারকী ও সমন্বয় করতেন এপিএস জাহিদ, তার খালু ফেবিয়ানের জিএম খোরশেদ আলম, ঢাকা বিভাগে প্রকৌশলীর দায়িত্বে ফিরোজ আলম। মন্ত্রীর ভাতিজা শাহাদাত হোসেন বিদেশি ঠিকাদার, কনসালটেন্ট ও বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলোর সাথে লিয়াজোঁ মেনটেইন করতেন। শাহাদাত একাজে তার প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিক নামধারী ভিডিও এডিটর সোহেলকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজে লাগাতেন। মন্ত্রীর স্ত্রী ফোজিয়া ইসলাম ও শ্যালক মহাব্বত আলীর বদলি বাণিজ্য-ঠিকাদারদের তদবিরগুলো ৭ মিন্টু রোডের সরকারি বাসভবন থেকে এপিএস জাহিদ সমন্বয় করতেন। ফৌজিয়া ইসলাম এর বান্ধবীর স্বামী সরকার কবিরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সরকার কবির ইন্টারন্যাশনালের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল এলজিইডি সহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের কেনাকাটা ও মন্ত্রণালয়ের ডিপিএম টেন্ডার বাণিজ্যে। সরকার কবির বুক ফুলিয়ে নিজেকে মন্ত্রীর স্ত্রী ফৌজিয়ার প্রতিনিধি দাবি করতেন। যা ছিল ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। মূলত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বাজেট ছিলো এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে। প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা বাজেটের মন্ত্রণালয়টির টেন্ডার ও কেনকাটায় এই সিন্ডিকেট বিগত ৬ বছরে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। ৫ জানুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দীরে ধীরে বেরুতে থাকে’ স্যার’ খ্যাত মোঃ তাজুল ইসলামের থলের বিড়াল।